নাস্তিকেরা ভালো মানুষ হতে পারে না কেন?

আমাদের আশেপাশে আমরা বহু লোক দেখি যারা সংশয়বাদী, অজ্ঞেয়বাদী, ধর্মবিরোধী, নিরীশ্বরবাদী বা নাস্তিক। কিন্তু তারা নিতান্তই ভালো মানুষ। দৃশ্যত এই ভালো মানুষরা যদি আসলেই ভালো মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে খোদার দরবারে তারা পুরস্কৃত হবেন না কেন? কেননা, ভালো কাজের পুরস্কার দেয়া এবং খারাপ কাজের শাস্তি দেওয়া, এটাই তো ন্যায় বিচারের দাবি। খোদা তায়ালা সত্যিই যদি ততটা উদার ও ন্যায়বিচারক হয়ে থাকেন তাহলে তিনি ‘নাস্তিক অথচ ভালো মানুষ’ এমন ধরনের মানুষদেরকে শাস্তি দিবেন কেন? তাঁর তো ‘উচিত’ সব ভালো মানুষদের পুরস্কৃত করা।

বিষয়টি কেমন গোলমেলে মনে হচ্ছে না?

এ সংক্রান্ত আগের আলোচনাটি ছিল ‘ঈশ্বরের ভালোবাসা নি:শর্ত নয় কেন‘। সেখানে আমরা আলোচনা করেছি, কীভাবে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন এবং কেন স্রষ্টা বা ঈশ্বরের ভালোবাসা তাঁর উপরে বিশ্বাস করার শর্তে শর্তাধীন। সেই আলোচনারই ধারাবাহিকতায় এই আলোচনা ‘একজন নাস্তিক কেন সত্যিকারের ভালো মানুষ হতে পারেন না’–

ফেইসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Mayan Mahmud: আপনি যে ভালো-খারাপ নির্ধারণ করছেন, তা অবশ্যই কোরআনের ভিত্তিতে। কোরআনের ভিত্তিতে নাস্তিকতা ব্যাপারটাই তো মহাপাপ, সৃষ্টিকর্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাও পাপ। তাহলে কোরআনকে ভিত্তি করে কথা বললে এত কথা কেন? এটা সবাই জানে। কোরআনের ভিত্তি ছাড়া আপনি নিশ্চয়ই কিছু বলেনও না।

Mohammad Mozammel Hoque: আপনি কি ভিডিওটা শুনেছেন? মনে হচ্ছে, শোনেন নাই। কেননা, এতে একটিও কোরআনের আয়াত বা হাদীসের রেফারেন্স বলা হয় নাই। আধাঘন্টা কথা বলেছি সম্পূর্ণভাবে যুক্তি-বুদ্ধির দৃষ্টিতে। বলতে পারেন, ডিসকাশনটা পিউরলি ফিলোসফিক্যাল। তাই, এগেইন প্লিজ! শুনেন একটু মনোযোগ দিয়ে। এরপরে স্পেসিফিক মন্তব্য করেন। অথবা বলেন, ভিডিওটির ঠিক কত মিনিট কত সেকেন্ডে অর্থাৎ কোন জায়গায় আমি ‘কোরআনের ভিত্তিতে’ কথা বলেছি।

Md Nayeem Watto: যারা সে বিষয়টিকে অস্বীকার করছে সেটা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাইবা কেন তারা করবে।

Mohammad Mozammel Hoque: হ্যাঁ, অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কথা। ঈশ্বরকে যারা স্বীকারই করে না, ঈশ্বরের বিচার, ন্যায়বিচার কিংবা ভালো-মন্দ ইত্যাদি কোনো কিছু নিয়েই তো তাদের পজিটিভলি এনগেজ হওয়ার কথা নয়। ঈশ্বর ন্যায় বিচারক নন, সেই জন্য ঈশ্বরকে না মানাতে একটা লজিক্যাল কন্ট্রাডিকশন তৈরি হয়। কারণ, লজিক্যালি ঈশ্বর থাকলেই তো তবে তিনি ন্যায়বিচারক হবেন কি না সে প্রসঙ্গ আসে। আর বলা বাহুল্য, ঈশ্বরের থাকা না থাকাটা তাঁর ন্যায়বিচার কিংবা এ ধরনের কোনো গুণের উপর নির্ভর করে না।

মূলত ঈশ্বর থাকার বিষয়টি নির্ভর করে আমরা থাকা, জগৎ থাকা এসবের ব্যাখ্যার উপর। এগুলোর কারণ হিসেবে আমরা ঈশ্বরকে অনুমান করি। তবে সে অনুমানটা এতটাই দৃঢ়ভাবে আমরা বিশ্বাস করি যে সেটা আমাদের চারপাশের দেখা বস্তুজগতের চেয়েও বেশি বা অধিকতর বা সুনিশ্চিত বলে আমরা মনে করি। সে জন্যই, আমরা বিশ্বাসী। আমাদের ঈশ্বর বিশ্বাস হচ্ছে আমাদের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতায় যা আমরা পেয়েছি বা আমরা যে আছি, সেটার ফলশ্রুতি।

অবিশ্বাসী বা নাস্তিকেরা ভুলভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসীদের উপর একটা অভিযোগ আরোপ করে। তারা স্ট্রম্যান ফ্যালাসির আশ্রয় নিয়ে বলে, ঈশ্বর বিশ্বাসীরা ঈশ্বর বিশ্বাস করে ভয় থেকে, না জানা থেকে। যেটাকে তারা গড অফ দ্যা গ্যাপস ‘যুক্তি’ হিসাবে বলে। এই গড অফ দ্যা গ্যাপস ‘যুক্তি’টা হলো আসলে একটা ভুল যুক্তি। এটলিস্ট আমার কাছে গড কোনো গ্যাপের বিষয় নয়। বরং যা আছে কোনো গ্যাপ ছাড়া একান্ত নিশ্চিতভাবে। যেমন– আমি বা আমরা কিংবা এই যে জগত, সেটারই অস্তিত্বের অপরিহার্য শর্ত বা উৎস হিসেবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিষয়টা আসে। আর ‘গড অফ দ্যা গ্যাপসের’ কথা তারাই বলে, যারা গডকে ভুল মনে করে। অর্থাৎ, অবিশ্বাসী নাস্তিক বা প্রকৃতিবাদীরাই আসলে এক ধরনের ‘গ্যাপ থিওরি’তে বিশ্বাস করে। তাদের এই প্রকৃতিবাদী gap theory হলো God of the chance থিওরি। তারা মনে করে, বাই চান্স এগুলো সব হয়ে গেছে।

আমি আমার বক্তব্যে যেটার উপর গুরুত্ব দিয়েছি সেটা হলো, given the laws of nature, or the rules of Physics থেকে আমরা বুঝলাম জগৎটা কীভাবে কীভাবে হয়েছে। তো ‘ঈশ্বর কোথা থেকে এসেছে?’ প্রশ্নটি যদি করা যায়, তাহলে ‘জগত সৃষ্টি হবার এই নিয়মগুলো কীভাবে আসলো? কোত্থেকে আসলো? কেনইবা এরকমই হলো? অন্যরকম কেন হলো না? অর্থাৎ, প্রকৃতির প্রকৃত প্রকৃতিইবা কী?’ – এইসব অন্টলজিক্যাল প্রশ্নের কী জবাব আছে প্রকৃতিবাদী নাস্তিকদের কাছে?

Md Nayeem Watto: জ্বী, প্রকৃতির প্রকৃতি একমাত্র প্রকৃতিরই জানা। যেমনভাবে একটি রোবটের সকল কর্মক্ষমতা কীভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে এবং কেন করা হয়েছে তা একমাত্র রোবট নির্মাতারই জানা।

Mohammad Mozammel Hoque: প্রকৃতিবাদীদের কাছে প্রকৃতি হচ্ছে তা-ই, ঈশ্বরবিশ্বাসীদের কাছে যা ঈশ্বর। ঈশ্বরবিশ্বাসকে অস্বীকার করার জন্য ‘প্রকৃতি’ নামক এই ফেনোমানাকে ব্যবহার করা হয়। মূলত প্রকৃতি বলতে আমরা যেটা বুঝাই সেটি হচ্ছে ঈশ্বরের কার্যপদ্ধতি মাত্র। In a sense, God is the embodiment of the laws of nature. এখন কেউ এটাকে ফিলোসফিক্যাল সেন্সে নিবে, নাকি পার্সোনাল সেন্সে নিবে সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিবেচনার ব্যাপার।

Siddikul Islam: সাউন্ডস সিস্টেমে পরিবর্তন আনলে ভালো হবে। আশা করি ভবিষ্যতে সাউন্ডস সিস্টেম ভালো হবে।

Mohammad Mozammel Hoque: আমাদেরকে আসলে নতুন একটা ভিডিও ক্যামেরা কিনতে হবে, যেটার মধ্যে মাইক্রোফোনের সরাসরি কানেকশন দেয়া যাবে। আমাদের বর্তমান ভিডিও ক্যামেরাতে এই সুবিধাটা নাই। যার কারণে ভয়েস রেকর্ডটা ততটা ভালো হয় না। আবার আলাদা ডিভাইস দিয়ে ভয়েস রেকর্ড করে ভিডিওর সাথে জোড়া লাগানোর জন্য এডিট করার যে ব্যাপারগুলো সেটার উপযোগী কোনো ব্যবস্থা আমাদের নাই। নানাবিধ সংকটের কারণে এই ধরনের অসুবিধা হচ্ছে। আশা করি তহবিল সংগ্রহ করার মাধ্যমে এর একটা সুরাহা করা সম্ভব হতে পারে। আমি যা কিছু করি সেটা আমার ব্যক্তিগত আয়ের, সোজা কথায় বেতনের টাকা থেকে করি। সেজন্য আমাদের কাজকর্মে নানা ধরনের লিমিটেশন আছে। তারপরও বাস্তবের দিকে তাকিয়ে, ময়দানের চাহিদা অনুসারে আমরা নানা ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এটাকে আমি নাম দিয়েছি ‘বুদ্ধিবৃত্তিক গেরিলা লড়াই’। এছাড়া আর এ মুহূর্তে কিইবা করার আছে?

আক্কাস আলী: স্যার, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে ভালো মানুষ হবার “অন্যতম” শর্ত হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা???? এখন যদি একজন নাস্তিক ভালো মানুষ তার অস্তিত্ব সংক্রান্ত প্রশ্নে একটা সিদ্ধান্তে আসে, ঠিক যেরকম আমরা আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে সিদ্ধান্তে এসেছি, আপনি কেন তার সামাজিক কার্যকলাপ বিবেচনায় তাকে ভালো মানুষ বলবেন না? কারণ সে ‘আমাদের’ সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞায় একমত নয় বলে? নাকি যতক্ষণ না পর্যন্ত সে ‘শান্তির ধর্ম’ ইসলামে না আসবে, ততক্ষন আপনি বলে যাবেন– ‘এখনো আপনার অস্তিত্বের প্রশ্নগুলো সলভ করতে পারেননি, সুতরাং আপনি পরিপূর্ণ ভালো মানুষ নন।’ মজার ব্যাপার হলো, কেউ যদি গবেষণা করে হিন্দু ধর্মকে যৌক্তিক মনে করে, তখন কি তাকে পরিপূর্ণ ভালো মানুষ বলবেন? আল্লাহর দৃষ্টিতে সে নিশ্চয় খারাপ মানুষ হবে। কারণ, গবেষণার পরেও তার উপর বিশ্বাস না আনতে পারাটা তো বোকামি!!? ?‍♂️

আসলে বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ আস্তিক সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞা নিয়ে চিন্তা করে না। তারা চিন্তাশীল নয়, ধর্মান্ধ; মোল্লা-হুজুরদের কাছ থেকে যা শুনে ও পড়ে, তাই বিশ্বাস করে। বিশেষ করে, আমাদের মুসলমানদের মধ্যে ‘সৃষ্টিকর্তার বৈশিষ্ট’ নিয়ে কুসংস্কার এতো বেশি যে নাস্তিকদের প্রশ্নের সামনে অপমানিত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখি না। এসব কুসংস্কার দূর করার পথও হাদীসের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মুসলমানরা আজ মূলত ইগ্নোরেন্ট ও অসহিষ্ণু একটা ধর্মীয় জাতি। আমরা সামাজিকভাবে ভালো হতে পারি, কিন্তু সামগ্রিকভাবে পরিপূর্ণ ভালো মানুষ নই। তাই তো?

Suvas Chondro Bosh: অস্থির বলেছেন। এর উত্তর কি উনার কাছে আছে?

Mohammad Mozammel Hoque: শুদ্ধ ইসলাম ও ভালো মানুষ হওয়ার সমস্যা: পাঠকের প্রশ্নের উত্তর

Suvas Chondro Bosh: আপনার এই ভিডিওটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। আপনার মূল আলোচনা শুরু হয়েছে ২৪ মিনিট থেকে।

আপনি যুক্তি দিয়েছেন, একজন নাস্তিক যতই ভালো কাজ করুক না কেন, সে যদি সে তার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন না করে, জগতের উদ্ভব নিয়ে তার মনে প্রশ্ন না জাগে তাহলে তার সকল ভালো কাজ = ০ এবং সে কখনই ভালো মানুষ নয়। আপনার এই উক্তিটি যথেষ্ট ইসলামী গলদে পরিপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।

আপনি মানুষের goodness বা badness নির্ণয় করছেন তার নিজের ও জগতের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন জাগা বা না জাগা এবং স্রষ্টার প্রতি ঈমান আনা বা না আনার ওপর ভিত্তি করে। এটা কখনই একজন মানুষের ভালো, মন্দ বিচারের মাপকাঠি নয়। মানুষের ভালো, মন্দ বিচার হয় তার মনুষ্যত্বের ওপর ভিত্তি করে। বেদ বলে মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রাণী। কারণ তার দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে– (১) মনুষ্যত্ব (২) আত্ম/ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা বা দেবত্ব। তো, এক নাস্তিক যদি আত্মজিজ্ঞাসা নাও করে, যদি সে মনুষ্যত্বের লালন করে, যেটিকে আমরা হিউম্যানিটি বলি, তাহলে অবশ্যই সে ভালো মানুষ। যদিও তার আত্মজিজ্ঞাসা নেই। তাকে বলা যেতেই পারে, সে আত্মজিজ্ঞাসু নয়। এ কথা বলতেই পারেন।

কিন্তু আত্মজিজ্ঞাসা নেই বলেই সে ভালো মানুষ নয়, তাই ইসলামের আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবে, ইসলামের এমন বক্তব্য জ্ঞানমূলক কথা নয়। আত্ম বা জগত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা একজন নাস্তিকের নাও থাকতে পারে। কিন্তু অবশ্যই সে ভালো মানুষ হতে পারে।

আপনার মতে, আত্মজিজ্ঞাসা যদি ১ ধরেন তাহলে সেই নাস্তিকের সকল ভালো কর্ম জিরো হয়ে যায়। তাতেও সমস্যা নাই। তারমানে আত্মজিজ্ঞাসা সম্বন্ধে উদাসীন নাস্তিকের স্কোর শূন্য। যার স্কোর শূন্য তাকে স্রষ্টা কেন শাস্তি দিতে যাবেন? ওই নাস্তিক আত্মজিজ্ঞাসু হয়নি বলে, তার স্রষ্টাকে খোঁজেনি বলে, তার স্রষ্টা তাকে শাস্তি দেবে, এটা কেমন যুক্তি? তাহলে কোরানের আল্লাহ কেন বললেন, যে যতই ভালো কাজ করুন না কেন, ঈমান না আনলে তাকে দোযখে পুড়তে হবে।। How cruelty it is!! শুধু তাই নয়, কোনো নাস্তিক যদি কখনো ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়েও যায় এবং ইসলাম না গ্রহণ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে, তাহলেও তাকে দোযখে পোড়াবে, আল্লাহ এমন থ্রেট দেয় কোরানে (সূরাঃ আল ইমরান, আয়াতঃ ৮৫)। তাই কোরানের ফিলোসফিকে বেস ধরে সব কিছু বিচার না করে স্রষ্টা সম্বন্ধীয় অন্যান্য ফিলোসফি পুনঃ পুনঃ অধ্যয়ন এ সংক্রান্ত প্রশ্নের যৌক্তির রেসপন্স প্রদানে সহায়ক বলে আমি মনে করি।

Mohammad Mozammel Hoque: আপনার কাছে ভিডিওটা পৌঁছেছে এবং আপনি সেটা দেখেছেন, দেখে প্রীত হলাম।

আমার টাইমলাইনে এ সংক্রান্ত কিছু বিষয় পাবেন যা ক্রমান্বয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এমনকি গতকাল পর্যন্ত এই আলোচনা বিস্তৃত হয়েছে। তা যদি ধারাবাহিকভাবে ফলো করেন, ভালো হয়।

আমি যুক্তি বুদ্ধির মানুষ। তাই কোরআনে বলেছে, হাদীসে বলেছে, ইসলামে বলেছে, অথবা বেদে বলেছে, পুরাণে বলেছে, বৈদিক ধর্ম বা সনাতনী ধর্মে বলেছে কিংবা যিশু বলেছেন কিংবা বুদ্ধ বলেছেন, এই ধরনের অ্যাপ্রোচে আমি অভ্যস্ত নই।

আমি যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে যে কোনো কিছুকে যাচাই করার পক্ষপাতি। আমি ‘বুদ্ধি-বিযুক্ত গোঁড়ামির’ (irrational dogmatism) পাশাপাশি ‘বুদ্ধির অন্ধত্ব’ থেকেও মুক্ত। মানবীয় যুক্তি-বুদ্ধির সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করে স্বীয় যুক্তি-বুদ্ধির সক্ষমতা নিয়ে এক ধরনের অতি-আশা বা উদ্ধত্য পোষণ করাই হচ্ছে বুদ্ধির অন্ধত্ব বা rational dogmatism।

স্রষ্টাকে যেখানে যথাযথভাবেই স্বীকার করা হয়নি, সেখানে স্রষ্টা কেন কাউকে ক্ষমা এবং পুরস্কৃত করবেন? হ্যাঁ, আমাদের দিক থেকে, অর্থাৎ জাগতিক দিক থেকে একজন নাস্তিক ব্যক্তি, পরিবারের সদস্য, সমাজের একজন বা নাগরিক হিসেবে ভালো মানুষ হতেই পারেন। সেটা তো আমি পরিষ্কার করেই বলেছি।

তদুপরি, একজন নাস্তিক ভালো মানুষ হওয়া তথা মানবতাবাদী হওয়াতে তো এটাই প্রমাণিত হয়, নাস্তিকতা ভুল। কারণ, এই যে মানবতাবাদ, মানুষের বিশেষ নৈতিক চেতনা বা প্রেরণা বা নৈতিকতা, এটি একটি অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য। মানুষের এই অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য, জড় বলতে আমরা যা বুঝি, সেটাকে অতিক্রম করে যায়। তাতে করে আমরা বুঝতে পারি, জড়জগতের পাশাপাশি রয়েছে অজড় বা বস্তু-অতিরিক্ত এক বিশেষ সত্তা বা জগত।

এই ধারায় চিন্তা করলে শেষ পর্যন্ত আমরা ঈশ্বরের ধারণায় উপনীত হই। এবং ঈশ্বরের ধারণাকে যদি আমরা যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা monotheistic তথা একেশ্বরবাদী ধারণাতে উপনীত হতে বাধ্য।

আমার অন্য একটা লেখা কিংবা বক্তব্যে আমি বলেছি, ঈশ্বর চাইলে নাস্তিকদের ক্ষমা করতে পারতেন। তিনি জগৎকে এভাবে সৃষ্টি না করে অন্যভাবে করতে পারতেন। কিন্তু কেন তিনি করেননি, সেটা আমি আপনি বা আমরা কেউ জানি না।

আমার বক্তব্য হলো, একচুয়ালি আমরা সেটা জানতেও পারি না। বিশেষ করে এই পয়েন্টটি বোঝার জন্য গতকালকে এই নিয়ে আমি যে ভিডিও বক্তব্য তৈরি করেছি এবং সাথে যে ফরওয়ার্ডিং লেখা দিয়েছি সেটি এক্সপ্লোর করার জন্য অনুরোধ করছি।

Masud Mannan: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, মনের কথাগুলো বলেছেন!

‘একটা মোবাইল কোম্পানি অফার করলো, আপনি যদি সামনের ৩ দিন ২০০ টাকার কথা বলেন তাহলে আরো ১০০ টাকা বোনাস পাবেন। পাশেই ছোট্ট করে লেখা, অফারটি পেতে হলে রেজিস্ট্রেশন করে নিন।

এখন একজন রেজিস্ট্রেশন না করে ৩ দিনে ২০০০ টাকার কথা বলে ১০০ টাকার কমিশনের আশায় বসে রইসে। ব্যাপারটা হাস্যকর নয়?

Mohammad Mozammel Hoque: যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না, তারা এটি দাবি করে যে, তাদের ভালো কাজগুলো স্রষ্টা গ্রহণ করবেন এবং তাদেরকে পুরস্কৃত করবেন। এটি নিতান্তই হাস্যকর (কু)যুক্তি!

আসল সমস্যা হলো, স্রষ্টার ধারণা নিয়ে তাদের বিভ্রান্তি। তাদের ধারণা অনুসারে খোদা হলেন আমাদের আশেপাশে দেখা বিভিন্ন অথরিটির মতো নিছকই একজন ঊর্ধ্বতন সত্তা। আপনার-আমার কিংবা জগতের অপরাপর বিষয় ও বস্তুগুলোর মতো যিনি কিছু ইউনিভার্সাল নিয়ম কানুন দ্বারা পরিচালিত।

এক ঈশ্বরবাদের ধারণার সাথে বহু ঈশ্বরবাদ ধারণার যে পার্থক্য, সেটাকে তারা গুলিয়ে ফেলেন। এর অন্তর্গত কারণ হলো, বহু ঈশ্বরবাদে যারা বিশ্বাস করেন, তারা পরমেশ্বরকে কার্যত অকার্যকর হিসেবে বিবেচনা করেন। অথবা অপরাপর অধীনস্ত দেবদেবী বা ছোট ঈশ্বরের মতোই চিন্তা করেন।

বলা বাহুল্য, প্যানথিইজম বা বহু ঈশ্বরবাদের যেসব ছোট ছোট খোদা বা দেবদেবী, তারা হলো আমাদের শক্তিশালী রাজা বাদশাদের মতো কাইন্ড অফ ডমিনেন্ট মেইল পার্সন টাইপের কিছু।

Tariq Al Mozahid: আমি এখানে একটি কথা বলতে চাই | আমি ভিডিওটি দেখিনি, কিন্তু পোস্টটি পড়ে যা বুঝতে পারছি, তা হলো, সেখানে বলা হয়েছে একজন নাস্তিক পুরোপুরি ভালো মানুষ হতে পারেন না। নাস্তিক ভালো মানুষ হোন বা নাই হোন, তার প্রতি ‘আস্তিকদের’ আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ সেটা বলে দেয়া আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে জরুরী ছিল।

আমার কাছে মনে হয়, এক্ষেত্রে ‘ভালো’-‘খারাপের’ ডেফিনিশন জরুরি। ‘ভালো-খারাপের’ আস্তিকি ডেফিনিশন অনুসারে একজন ‘ভালো’ মানুষ বাই ডেফিনিশিন ‘আস্তিক’। আস্তিকরা ‘নাস্তিক কিন্তু একটু ভালো মানুষ’ এ রকম কথা চিন্তা করছে কী করে? আস্তিকদের চিন্তাভাবনা অনুযায়ী একজন ‘ভালো’ মানুষ বাই ডেফিনিশন আস্তিক। আস্তিকদের ‘ভালো’র ডেফিনিশন সেরকমই ইঙ্গিত দেয়। আস্তিকদের কল্পনায় কোনো ‘ভালো নাস্তিক’ থাকতে পারে না। আর ভালো-খারাপ কখনও ‘একটু’ হয় না। আপনি যদি ‘একটু ভালো’ আর্গুমেন্টে অনড় থাকেন তাহলে ‘একটু আস্তিক’ আর্গুমেন্টের সাথে দ্বিমত পোষণ করা উচিৎ হবে না।

‘ভালো-খারাপ’ একটু-আধটু হতে পারলে আস্তিকতা-নাস্তিকতাও ‘একটু-আধটু’ হতে পারে।

আমাদের উচিৎ আমাদের নিজেদের সমর্থন করা ডেফিনিশনে স্থির থাকা। এর অন্যথা হলো cowardice.

Mohammad Mozammel Hoque: আমাদের অস্তিত্বের নানা রকমের মাত্রা রয়েছে। নিতান্ত ব্যক্তি হিসেবে আমি। পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি। সমাজের একজন হিসেবে আমি। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমি। সর্বোপরি মানুষ প্রজাতির একজন হিসেবে আমি। এগুলো পরস্পরের বিপরীতও নয়, আবার অভিন্নও নয়।

সেজন্য মানুষ হিসেবে আমাদের এই ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়গুলোর কোনো একটিতে আমরা খারাপ হওয়ার মানে এই নয় যে অন্য কোনোটিতে বা সবগুলোতেও আমরা খারাপ হবো। এর বিপরীতে, এর কোনো একটিতে আমরা ভালো হওয়ার মানে এই নয় যে মানুষ হিসেবে আমাদের যেসব পরিচয়, সেগুলোর বাদবাকি সবগুলোতেও আমরা ভালো হবো।

আস্তিকতা-নাস্তিকতা আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, নাগরিক বা প্রজাতিগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে বৃহত্তর একটা ব্যাপার। যদিও এটি প্রত্যক্ষভাবে আমাদের এসব আরোপিত পরিচয় বা আইডেন্টিটির সাথে সাংঘর্ষিক বা নেসেসারিলি রিলেটেড নয়।

তৎসত্ত্বেও এটি আমাদের সব ধরনের পরিচয়ের ওপর অন্তর্গতভাবে বা পরোক্ষভাবে মৌলিক প্রভাব সৃষ্টি করে।

আমরা জানি, প্রত্যেক ব্যক্তির কোনো না কোনো ওয়ার্ল্ড-ভিউ বা বিশ্বদৃষ্টি থাকে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জীবনের বাদবাকি সবকিছু সেই meta-paradigm বা বিশ্বদৃষ্টি দ্বারা influenced হয়ে থাকে। এই কথাগুলোর আলোকে আমি কী বলতে চেয়েছি সেটি যে কেউ চাইলে বুঝতে পারবে।

Tariq Al Mozahid: আমি হয়তো কমেন্টে একটু ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম, তার জন্য দুঃখিত।

ব্যাপারটা হলো গিয়ে মানুষ ভালো-খারাপের ক্ষেত্রে বলে ‘একটু’ ভালো কিংবা ‘সম্পূর্ণ’ ভালো। কিন্তু আস্তিকতা নাস্তিকতার ক্ষেত্রে একটু আস্তিক এবং সম্পূর্ণ আস্তিক এভাবে বলে না কেন? আপনি বললেন যে আমাদের অস্তিত্বের অনেকগুলো মাত্রা রয়েছে। কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট মাত্রাতেও একজন মানুষ সম্পূর্ণ ভালো কিংবা অর্ধেক ভালো হতে পারে। আস্তিকতা-নাস্তিকতার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।

তাছাড়া আস্তিক বা নাস্তিক হওয়া আসলে কী? একজন মানুষ কি পুরোপুরি জানে যে সে আস্তিক নাকি নাস্তিক? আপনি বললেন যে আস্তিকতা বা নাস্তিকতা আমাদের বিভিন্ন পরিচয়ের ঊর্ধ্বের একটি ব্যাপার। আমাদের অন্যান্য পরিচয়ের ক্ষেত্রে যেমন মৌখিক দাবিকেই শেষ ধরে নেয়া হয়, আস্তিকতা কিংবা নাস্তিকতার ক্ষেত্রে কি সেই একই ব্যাপার খাটে? আস্তিকতা বা নাস্তিকতা কি কেবলই একটি মৌখিক দাবির বিষয়?

Mohammad Mozammel Hoque: মোটেও না। এটা একটা জীবনবোধের ব্যাপার। Its most intrinsic inner something।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

আপনার মন্তব্য/প্রশ্ন লিখুন

ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক।

*