সত্য মিথ্যা আর জীবনের পথ চলা

সবাই বলে, সত্য অনুসন্ধান কর। কিন্তু সত্যটা কোথায়, কীভাবে পাব? কীভাবেই বা জানব, এটিই হলো আসল সত্য?

জ্ঞানতত্ত্বের প্রচলিত সংজ্ঞা মোতাবেক, জ্ঞান হলো যাচাইকৃত সত্য বিশ্বাস। এখানে যাচাই হলো সত্যকে পাওয়ার পদ্ধতি, বিশ্বাস হলো প্রাপ্ত সত্যকে ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করে নেয়া। এই JTB account of knowledge-এর মধ্যে জ্ঞানের মূল শর্তটি হলো বিষয়টি সত্য হওয়া।

অথচ সত্য হলো চির অধরা। সত্য জেনে যা কিছুকে আমরা আঁকড়ে ধরি, কখনো কখনো দেখা যায় সেটাকে এক পর্যায়ে আমরা মিথ্যা হিসেবে ছুড়ে ফেলে দেই। ভুল হিসেবে প্রত্যাখ্যান করি।

এমতাবস্থায় এখন যেটাকে আমি সত্য মনে করছি, কী এমন গ্যারান্টি আছে যে আগামীকাল বা পরশু সেটাকেই আমি মিথ্যা বলে মনে করব না? এটি একটি সংশয়বাদী যুক্তি। একে argument from error বলা হয়।

সংশয়বাদী যুক্তিটি যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে অন্তত পক্ষে আমরা এতটুকু জানলাম যে সংশয়-সন্দেহ করার জেনুইন কারণ থাকতে পারে। এবং ডেকার্টের পদ্ধতি বা cartesian method অনুসারে আমরা বলতে পারি, আমাদের এই সন্দেহ করার প্রক্রিয়াটা অন্তত নিশ্চিত। তার মানে হলো, এমনকি আমরা সংশয়বাদী হয়ে থাকলেও অন্তত এতটুকু জানি– যা কিছু আমরা জানি সেটি নিশ্চিত নয়।

তারমানে, আমরা কিছু না কিছু জানি। কথাটা উল্টোভাবে বললে এভাবে বলা যায়, আমরা নিশ্চিত নই, এমন ব্যাপারে অন্ততপক্ষে আমরা এতটুকু নিশ্চিত যে, আমরা নিশ্চিত নই। অর্থাৎ এক অনিশ্চয়তার নিশ্চয়তা আমাদেরকে সব সময়ে তাড়া করে ফেরে। সংশয়বাদী হওয়ার মাধ্যমেও জ্ঞানের এই অপরিহার্যতা থেকে আমরা নিষ্কৃতি পেতে পারি না।

তার মানে হলো, যা আমি সব সময় বলে থাকি, তাত্ত্বিকভাবে বা ontologically, knowledge is a must। না জেনে জীবিত থাকার কোনো সুযোগ নাই।

এই লাইনে আপনি যতই চিন্তা করবেন ততই বুঝতে পারবেন, জ্ঞানের সম্ভাব্যতার বিপক্ষে যত দাবি উত্থাপন করা হয়, শেষ পর্যন্ত তার সবগুলোই স্ববিরোধী বা self-refuting আর্গুমেন্ট হিসাবে ধ্বসে পড়ে।

অতএব, সত্য চাই। আমিও চাই, আপনিও চান। সবাই চায় আসল সত্যকে পেতে। এই সহজাত ও গণ-চাওয়ার ব্যাপারে অন্য অনেকের সাথে আমার পার্থক্য হলো, আমি মনে করি, আমি মোটাদাগে সত্যকে পেয়ে গেছি। আমি অলরেডি সত্যের পথেই আছি। নিজের ব্যাপারে আপনি কতটুকু জানেন, তা জানি না। তবে আপনার ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত জানি, কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবে, জগৎ ও জীবনের আসল সত্যটা আপনার কাছে যেভাবেই হোক না কেন ইতোমধ্যেই আছে। It is already given to you, in  your conscience. নোবডি, প্রকৃতি কিংবা ঈশ্বর, যে-ই এটি দিক না কেন।

ইনফ্যাক্ট আপনি সত্যের উপরই আছেন। সচেতনভাবে বা কাজে-কর্মে যা-ই হোক না কেন, স্বীয় অন্তর্গত প্রেরণায়, নিজের কাছে নিজে আপনি-আমি এবং প্রতিটা মানুষই বিশুদ্ধ সত্যবাদী। নিজের কাছে নিজে কেউ কখনো মিথ্যা বলতে পারে না। সত্যের আলো থেকে নিজেকে কেউ কখনো ফিরিয়ে রাখতে পারে না। অন্তরের দেখানো সেই সত্যের আলোতে পথ চলবে কিনা, সেটি ভিন্ন বিষয়। ইনফ্যাক্ট, আপন আলোয় পথ চলার এ ব্যাপারটি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ইন্টেনশন বা নিয়তের উপরে।

অতএব কাজের কাজ হলো, সত্যের উপর টিকে থাকার চেষ্টা করা এবং অধিকতর ভালোভাবে সত্যকে পাওয়ার এবং অধিকতর মজবুতভাবে সত্যের উপর টিকে থাকার আপ্রাণ ও সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট হওয়া।

হে মোর প্রিয় সুহৃদ বন্ধুবর! যদি চাও হতে আরও প্রিয়তর, তাহলে বিবেকের দেখানো পথে নির্ভেজাল, নিরেট সত্যকেই অনুসরণ করো। হও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, সত্যের প্রশ্নে আপসহীন। মিথ্যার সাথে ছিন্ন করো সব সম্পর্ক। হয় যত ক্ষতি তাতে, হোক। তবুও সত্যের পথে এগিয়ে চলো, শ্রান্তিহীন, ক্লান্তিহীন, নিশিদিন। বেঁচে থাকো প্রতিটা ক্ষণে, সত্যবাদিতার আত্মতুষ্টি নিয়ে।

‘কার সত্য’ বা ‘কোন সত্য’, এগুলো নিয়ে খুব একটা ভাবিত হওয়ার দরকার নাই। শুধু সত্যের প্রশ্নে হও দ্বীধাহীন, নির্দয়। আমি নিশ্চিত, তোমার আন্তরিক প্রচেষ্টা আর ঐকান্তিকতাই তোমাকে নিয়ে যাবে অখন্ড সত্যের দিকে। খুব বেশি দেরিতে নয়, অবশ্যই পেয়ে যাবে তুমি এমন সত্য, যা মিথ্যা হবে না কোনোদিন। সত্যপ্রবণ যেকোনো মানুষের মনে আসল সত্যটাই প্রতিভাত হবে, অনতিবিলম্বে; এটাই প্রকৃতির নিয়ম। এর ব্যত্যয় নেই কোনো।

হ্যাঁ, সত্যসন্ধানীর ভুল হতে পারে। ক্ষতি নাই তাতে। সেই ভুলের সংশোধন হবেই হবে। কীভাবে হবে, তা নিয়ে টেনশন করার দরকার নাই।

জেনে রাখো, প্রকৃতি রহস্যময়, এটি যতটা সত্য; সত্যসন্ধানী মানুষের কাছে প্রকৃতি হলো উর্বরা মাটির মতো সদাপ্রস্তুত, অবনত, receptive; এটিও তারচেয়েও বড় সত্য।

Robert nozick, জাস্টিফিকেশন প্রসঙ্গে তার conditional theory of truthএ একথাই বলার চেষ্টা করেছেন। তার মতে, adherence to truth, বা সত্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ, একটি দুর্নিবার, অনিবার্য এবং অবশ্যম্ভাবী। সত্যকে মানুষ না জেনে থাকতে পারে না। নিজের কাছে নিজে সত্যকে মানুষ করতে পারে না অস্বীকার।

সত্যের স্বরূপ অনির্ণেয়, এটি যতখানি সত্য, তেমনি করে, সত্য সবসময়ই প্রতিভাত হয়, এটিও ততখানি সত্য। সত্য স্বরূপত: সর্বদা এক ও অভিন্ন, কিন্তু ব্যক্তিমানুষের দিক থেকে, অর্থাৎ জ্ঞাগতভাবে সত্য প্রতিভাত হয় নানা মাত্রায়। একেক অবস্থান ও গভীরতা থেকে সত্যের একেকটা রূপ ফুটে ওঠে।

Particular entity বা স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন একজন ব্যক্তিমানুষ হিসেবে পরিপূর্ণ সত্যকে জানার জন্য আমাদের যে যাত্রা, তা অন্তহীন। অনন্ত এই সত্য পথ যাত্রায়, একজন সত্যসন্ধানী হিসেবে তোমাকে জানাই স্বাগতম। শেষ পর্যন্ত যদি এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় হও অদম্য, তাহলে অবশ্যই সঠিক পথের শুরুর জায়গাতে তুমি এসে পড়বে নিশ্চিত।

আর হ্যাঁ মনে রাখবে, মিথ্যা মানে অনেকখানি সত্যের সাথে খানিকটা মিথ্যার মিশ্রণ। আর, সত্য হলো আগাগোড়া সত্য। তাই, সব সময় সতর্ক থেকো, যাতে সত্যের মধ্যে খানিকটা মিথ্যা ঢুকে না পরে।

এ জগত সত্য। এ জীবন সত্য। জগতের বাদবাকি সব কিছুর মতো তুমিও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনন্য। তোমার জীবনেরও আছে বিশেষ একটি লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য। এটি সত্য। জীবনের একটি ধারাবাহিকতা আছে, এটিও সত্য। সেজন্য চাই, নিজের মতো করে তুমি জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে খুঁজে নাও, বেছে নাও তোমার জীবন চলার পথ।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

১টি মন্তব্য

  1. আমাদের জীবনের তবে উদ্দেশ্য কী? আমরা কেন আছি? আমি কেন আছি? এই মহাজগতে আমার কাজ কী? আমার কাজ কি শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা, যেকোনো উপায়ে বেঁচে থাকা? আর এই বেঁচে থাকবার তাগিদ থেকেই কি আমি মনে করছি যে আমার জীবনের “উদ্দেশ্য” আছে?

আপনার মন্তব্য/প্রশ্ন লিখুন

ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক।

*