বস্তু, গুণ ও আত্মা: তাত্ত্বিকদের সন্ধানে রিপোস্ট

পোস্ট দেয়ার সাত ঘণ্টা পরেও মাত্র দুটি অতি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য পড়ায় হতাশ হয়ে ব্লগীয় তাত্ত্বিকদের সন্ধানে/সমীপে গঠনমূলক সমালোচনা/মন্তব্যের আশায় রিপোস্ট–

হেগেলের তিনটি সূত্র আছে যেগুলো সাধারণভাবে তাঁর অন্যতম ছাত্র মার্ক্সের নামে প্রচারিত। এগুলোর মধ্যে পরিমাণের গুণে রূপান্তর হলো দ্বিতীয় সূত্র।

বস্তুর ‘নির্দিষ্ট’ পরিমাণ ঘটলে নতুন গুণের আগমন ঘটে। যেমন– একটি ঘড়ির প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশগুলোকে ‘নির্দিষ্ট’ভাবে একত্রিত (সংযোজন অর্থে) করলে নতুন একটা কিছু পাওয়া যায়– সময়।

এই দৃষ্টিতে গুণ বস্তুকে আশ্রয় করে থাকে বটে তবে তা বস্তু-অতিরিক্ত, কিন্তু বস্তু-নিরপেক্ষ বা স্বাধীন নয়। গুণ বস্তুর অংশও নয়। ঘড়ির যন্ত্রাংশের মধ্যে ‘সময়’ বলে কোনো পার্টস নাই।

বস্তু থেকে গুণ আলাদা কিনা– এই নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক রয়েছে।

মার্ক্সিস্টরা মনে করেন, মন হলো মস্তিষ্কের উপজাত বা বাই-প্রডাক্ট। মন দেহকে প্রভাবিত করতে পারে না। দেহই মনকে গঠন করে। এই তত্ত্বের বিপক্ষে অনেক আলোচনা আছে। সেসব এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। মার্ক্সের মতানুসারে, মনের স্ট্যাটাস বস্তুর গুণের সমতুল্য।

মন নিয়ে প্রাচ্যের চিন্তাধারায় ব্যাপক ভেরিয়েশন আছে। মন ও আত্মাকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়। ইংরেজিতে mind, soul, spirit ইত্যাদি আলাদা শব্দ থাকলেও তত্ত্বীয় আলোচনায় সবকিছুকে মাইন্ড বা মন হিসাবে ট্রিট করা হয়।

গুণকে যদি বস্তুনির্ভর কিন্তু বস্তুর অতিরিক্ত (যেমন– ঘড়ি ও সময়ের ধারণা) হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিজ্ঞান ‘প্রাণ’ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও আত্মার ধারণা নাকচ হয়ে যাবে না। কারণ, আত্মা দেহকে ভর করে থাকে, অথচ তা দেহাতীত।

আত্মার আর একটি বড় প্রমাণ হলো– মৃত্যুর অব্যবহিত পরেও দেহ ইনট্যাক্ট থাকে। তাহলে পরিবর্তনটা কী, যাকে আমরা মৃত্যু বলছি? সেটি হলো আত্মার অনুপস্থিতি।

আত্মাকে কেন্দ্র করে মৃত্যু পরবর্তী কোনো জীবন আছে কিনা, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। উপরে আমি যে ধরনের ব্যাখ্যা দিলাম তাতে মন বা আত্মার উপস্থিতি অনিবার্য।

এখানে মার্ক্সিস্টরা বলতে পারেন– দেহের অপরিহার্য (বস্তুগত) ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে বলেই ‘মৃত্য’ ঘটেছে। অর্থাৎ বিপরীতের ঐক্য নষ্ট হয়েছে। তাই নতুন সিন্থেসিস হয়েছে। যেটিকে বলা হয় নিগেশন অব নিগেশন। এখানে মনের বা আত্মার কোনো প্রসঙ্গ অবান্তর।

প্রশ্ন হলো– এই ‘বিপরীতের ঐক্য’ কেন নষ্ট হলো? যদি অন্য কোথাও কোনো ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে এখানে এফেক্ট পড়েছে বলা হয়, তাহলে ‘বেগিং দ্যা কোয়েশ্চন’ হতে বাঁচার জন্য প্রশ্ন করতে হবে– সেখানে ভারসাম্য নষ্ট হলো কেন? এভাবে আপনাকে ‘কেন’ প্রশ্নের অন্তহীন পরম্পরাতে গিয়ে এক পর্যায়ে ‘অসীম’ নামের এক ফিলোসফিক্যাল গডে বিশ্বাস করতে হবে (অবচেতনে এটলিস্ট); অথবা স্বীকার করতে হবে, এই বস্তু তথা দেহে এমন একটা কিছু ছিল যার জন্য এটি ফাংশনিং ছিল। যেটির অনুপস্থিতিতে বস্তু তথা দেহটি সজীব থাকা সত্ত্বেও ফল করেছে। যে ঘটনাকে আমরা মৃত্যু বলছি।

দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ বা সামগ্রিকভাবে দেহ অচল হওয়ার কারণে মৃত্যু ঘটে না। বরং মৃত্যু ঘটার কারণে দেহের অঙ্গ-প্রত্যংগসমূহ অচল হয়ে পড়ে। তাহলে কী সেই ব্যাপার, যা বিয়োজিত হওয়ায় ভারসাম্য নষ্ট হয়, দেহ আর কাজ করে না, ধীরে অথবা দ্রুত অচল হয়ে পড়ে?

আমাদের প্রগতিশীল বিজ্ঞানবাদী বন্ধুরা স্বীকার করতে না চাইলেও জীবনের জন্য অপরিহার্য এই ‘একটা কিছু’ হলো আত্মা, যার সঠিক পরিচয় অজানা। যার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির ফলাফলকে দেখা যায়। যেটি না থাকলে জীবনের সব শক্তি ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। সংক্ষেপে আত্মা হলো জীবনীশক্তি। আত্মাকে যদি আমরা স্বীকার করি তাহলে দেহে অবস্থিত কিন্তু দেহ-অতিরিক্ত, কখনো কখনো দেহকে নিয়ন্ত্রণকারী মনকে অস্বীকার করার কোনো কারণ নাই। কথাটি বিপরীতক্রমেও সমসত্য।

আমাদের সুশীল বন্ধুদের একটা অংশ আত্মাকে অস্বীকার করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তাদের ভয় আত্মা বা মনের জানালা দিয়ে না আবার ধর্মের ‘দূষিত’ বাতাস ঢুকে পড়ে! না জানি এতে ইহজাগতিকতার ‘অতি পবিত্রতা’ ক্ষুণ্ন হয়ে পড়ে!

এভাবে ভাবুন: বস্তু → শক্তি → গুণ → মন → আত্মা।

সুধীবৃন্দ, অতি বিশ্বাসীরা অদেখা আত্মাকে যেমন আমাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও চতুর্পাশ্বস্থ বস্তুনিচয়ের চেয়েও বেশি দেখা মনে করেন, তেমনি আপনারা যারা প্রগতিশীলতার (নিশ্চয়ই মননে) দাবি করেন, আপনারা যুক্তির বাহিরে গিয়ে আত্মা বা মনকে অস্বীকার ও বস্তুকে আত্মার সকল বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে ‘বস্তু’ নামে জপ করা হতে বিরত থাকবেন। অনুরোধ। দেহাতিরিক্ত কিছু যদি থেকে থাকে, তাকে স্বীকার করে নেয়া ভালো। সেজন্য ঈশ্বরবাদী হতে হবে এমন কোনো কথা নাই। ধর্মের (আসলে ধর্মবাদীদের) পক্ষে চলে যেতে পারে– এই আশংকায় আত্মা বা মনকে যুক্তিসঙ্গত হওয়া সত্ত্বেও জোর করে অস্বীকার করার চেষ্টা করা ধর্মবাদীদের অজ্ঞতা ও অসহিষ্ণুতার মতোই একটা অগ্রহণযোগ্য ও অনভিপ্রেত চরমপন্থা; বলা যায় এক ধরনের চিন্তা ও মতাদর্শগত সাম্প্রদায়িকতা।

টীকা: ‘বিজ্ঞানবাদী’ পরিভাষাটি আমার দেয়া। এর সঠিক ইংরেজি কী হবে বুঝতে পারছি না। তবে ধারণাটা এ রকম: বিজ্ঞানবাদী হচ্ছেন তারা, যারা বিশ্বাস করেন– বিজ্ঞান আমাদেরকে একটি পূর্ণ জীবনাদর্শ দিতে পারে। বিজ্ঞান আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তরদানে সক্ষম। যা পাওয়া যায় নাই তা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিজ্ঞানই হলো একমাত্র পন্থা।

আসলে বিজ্ঞান আমাদেরকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। ব্যাপকভাবে। প্রযুক্তি আমাদের কাজে লাগে। সাধারণ মানুষের বিজ্ঞানসংশ্লিষ্টতা হলো প্রযুক্তি তথা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রাপ্তি। এর বাইরে বিজ্ঞানের যত তত্ত্ব সবই ফিলোসফিক্যাল, নট ফিলোসফি ইটসেলফ; বাট দিস ট্রেন্ড ইজ ফিলোসফিক্যাল। আমার এক সহকর্মী সায়েন্টিফিক রিয়্যালিজমের উপরে কাজ করে ডক্টর হয়েছেন। তিনি জোরেশোরে বলেন, বিজ্ঞানকে যতটা অবজেক্টিভ দাবি করা (বিজ্ঞানবাদীরা) হয়, বিজ্ঞান ততটা অবজেক্টিভ নয়। শুধুমাত্র পরীক্ষণলব্ধ ফলাফলই (বৈজ্ঞানিক) জ্ঞান নয়। প্রাপ্ত ফলাফলকে বিশ্লেষণ করে তত্ত্ব নির্মাণই লক্ষ্য, যাতে অদেখা থাকে অনেকটুকু। এ প্রসঙ্গে পপার, কুন, ফিয়ারাব্যান্ড প্রমুখের লেখা পড়ে দেখা যেতে পারে।

নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

আলামিনস্টাইন: আপনার পোস্টগুলো ভালো লাগে। অনেক যুক্তিমূলক পোস্ট।

বস্তুবাদী চিন্তা দ্বারা আমরা মন এবং আত্মার পার্থক্য খুঁজে পাব না বলেই আমার বিশ্বাস।

দেহ-মন প্রত্যেকেই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তাই সাধারণভাবেই আমরা আত্মাকে মনের সাথে এক করে ফেলি। আর বাস্তব সত্য কথা হলো আমরা আত্মার সঠিক অস্তিত্ব আজও খুঁজে পাইনি।

আমি বিজ্ঞানে বিশ্বাসী হলেও মনে করি, এমন অনেক কিছুই আছে, যা এখনও বিজ্ঞান ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তাই বিজ্ঞান এখনও অপরিপক্ক।

ফিলোসফিতে আমার ভালো আগ্রহ আছে। কোথা থেকে শুরু করা যায় বলুন তো?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আমার এক সহকর্মী জি এইচ হাবীব অনূদিত ‘সোফির জগৎ’ বইটি অথবা যে কোনো বই দিয়ে শুরু করতে পারেন।

আমি মেট্রিক-ইন্টারে সায়েন্সের ছাত্র ছিলাম। জিদ করে ফ্যামিলির অমতে গিয়ে প্রেম করে বিয়ে করার মতো ফিলোসফিতে ভর্তি হয়েছিলাম। এখনো মনে করি, আমি ভুল করি নাই। তবে মানুষ ফিলোসফিকে ভুল বোঝে। এর জন্য দায়ী হলো তারা, যারা ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টগুলোতে শিক্ষকতার চাকরি করে।

Anyone who do think, he does philosophy; no matter he does or does not know (actually be aware) that he is doing philosophy. Thanks.

পারভেজ আলম: দুঃখিত, ব্যস্ত থাকায় সময় মতো রিপ্লাই করতে পারি নাই।

আপনার পুরো লেখার আমি শুধু মাঝখানের একটা অংশ নিয়ে আলোচনা করবো। “ভারসাম্য নষ্ট হলো কেন?” এই প্রশ্নের উত্তর জানতে অন্তহীন পরস্পরার দরকার পরবে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে যদি আপনার অন্তহীন পরস্পরার দরকার হয়, তাইলে তো যে কোনো প্রশ্নের উত্তর জানতেই অন্তহীন পরস্পরা আনতে হবে, আর শেষ পর্যন্ত অসীমের কাছে আত্মসমর্পণ করে উত্তর খোঁজা বাদ দিতে হবে।

মধ্যযুগে মানুষের শরীর অধিবিদ্যার অধীন ছিল, এখন আর নাই। মানুষের শরীর কীভাবে ফাংশন করে সেটা এখন জানা যায়। মধ্যযুগে লাঙল দিয়ে হাল চাষের প্রসঙ্গ অধিবিদ্যার অধীন ছিল না, বাস্তব জ্ঞানের অধীন ছিল। চিকিৎসা শাস্ত্র এখন যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে তাতে মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ফাংশন এবং মৃত্যুর কারণ বর্তমান সময়ে মানুষের বাস্তব জ্ঞানে পরিণত হয়েছে। একটা বিষয়ে যেখানে আমাদের বাস্তব জ্ঞান রয়েছে, সেইখানে অধিবিদ্যার আশ্রয় নেয়া গ্রহণযোগ্য মনে করি না, তা থেকে কোনো সমাধানও আসে না।

মানুষ তার ডিএনএ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করে যায়। দেহবিনাশের পরেও যা টিকে থাকে তা এই ডিএনএর অন্তস্থ তথ্য, যা পরবর্তী প্রজন্মের টিকে থাকতে কাজে লাগে। দেহবিনাশের পর টিকে থাকলেও এই তথ্যকে অমর বলা যায় না, তবে তা অমর হওয়ার চেষ্টায় রত। আরেকটা জিনিস টিকে থাকে, আর তা হলো দার্শনিক এবং শিল্পীদের ‘বিশ্লেষিত তথ্য’, মৌখিক এবং লিখিত আকারে, এটাও অমর হওয়ার চেষ্টায় রত, অবিরাম অন্যান্য বিশ্লেষিত তথ্যের সাথে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে, অথবা একটা সামগ্রিক আকার পাওয়ার চেষ্টা করছে সবগুলো একসাথে মিলে। এই বিষয়গুলো নিয়ে অধিবিদ্যক চিন্তা হতে পারে, আমি করি।

আর আপনার পোস্টগুলো একেবারে খাঁটি দার্শনিক ভাষায় করেন বলে অনেকেরই বুঝতে সমস্যা হয়। এই কারণে প্রতিক্রিয়া কম পান।

আমি কিছু কিছু দার্শনিক বিষয় এই ব্লগে সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেছি, তাতে অনেক সুবিধা হয়।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: সব সময় নেটে থাকতে পারি না। তাই সময় মতো রেসপন্স করতে পারি না। সে জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

ভাই, সহজভাবে বলা কঠিন। তাই…

বর্তমান বিজ্ঞানে আপনার অটুট আস্থার বিষয়ে বলছি– কোনো এক মনীষী বলেছেন, এভরি পয়েন্ট ইজ দ্যা ক্রস পয়েন্ট অফ ইনফাইনিটি। সো, বিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত মনে করা হতো– এই তো পেয়ে গেছি…। পরে দেখা গেল যেটাকে মনে করা হতো ক্ষুদ্রতম একক, সেটি আসলে অধিকতর ক্ষুদ্রতর, অধিকতর জটিল, বহুর সমষ্টি বা বহিঃপ্রকাশ। বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট ডেভেলপ করেছে অ্যাট দ্যা মিড টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরিতে, আপনি জানেন। তাই, বিজ্ঞান সব পেয়ে গেলো বা পেলো বলে– এ জাতীয় কথাবার্তা আমার বিবেচনায় আবেগপ্রসূত।

হ্যাঁ, বিজ্ঞানের অনেক অনেক বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে বটে। কিন্তু এতে জানার তৃষ্ণা কেবলই বেড়েছে। কোনো এক কবিতায় পড়েছিলাম,

Yet All experience is an arch wherethrough.
Gleams that untraveled world whose margin fades.
Forever and forever when I move.

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

পারভেজ আলম: বর্তমান বিজ্ঞানে আমার অটুট আস্থা– এমন নয়। আমাদের সময়ের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানগুলো যে সর্বকালের জন্য সঠিক থাকবে, তাও মনে করি না। তবে কিছু বেসিক বিষয় আবিষ্কৃত হয়ে গেছে, ভবিষ্যতে এগুলো ভুল প্রমাণিত হবে না, তবে এগুলোকে বোঝার আঙ্গিক বাড়বে। বিজ্ঞান সব পেয়ে গেল– এমনটাও বলি নাই। তবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের গ্রহ নক্ষত্রের উৎপত্তি এবং গতি বিষয়ক অনেক অধিবিদ্যক ধারণা যেমন এখন খাটে না, তেমনি খাটে না মানব শরীর এবং মৃত্যু নিয়ে। কৃষক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কৃষি বিষয়ক যে জ্ঞান অর্জন করেছে তা বাস্তব জ্ঞান। মেডিকেল সাইন্সের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। একটা সময় ছিল যখন মানুষের ইন্টেলিজেন্সকে ব্যাখ্যা করতে আত্মার ধারণার বিকল্প ছিল না, এখন আছে। বরং মানব শরীর নিয়ে এখন আমাদের যেই বাস্তব জ্ঞান আছে, তাতে আত্মাকে একটা জায়গা দেয়াই বরং সমস্যা হয়ে যায়।

যেসব বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান আছে, সেসব বিষয়ে তো অধিবিদ্যার দরকার নাই, খাটেও না, এইটা আপনেও জানেন।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: হ্যাঁ ভাই, যেসব বিষয়ে বাস্তব জ্ঞান আছে, সেসব বিষয়ে অধিবিদ্যার দরকার নাই, খাটেও না। এটি আমি জানি। এবং জানি না।

কারণ, আপনি সম্ভবত বোঝাতে চাইছেন, আমি এই যে টেবিলের উপরে ল্যাপটপে লিখছি, পাশে একটি মোবাইল সেট আছে, একটি বাতি জ্বলছে ইত্যাদি বাস্তব, যা সম্বন্ধে অধিবিদ্যা খাটে না।

সাধারণত, সাধারণ লোকেরা তা-ই ভাবে। তারা ভাবে– অধিবিদ্যা হলো ঈশ্বর, জগত, সত্যতা ইত্যকার বৃহত্তর, জটিলতর বিষয়সংশ্লিষ্ট।

হ্যাঁ, সাধারণ মানুষের অধিবিদ্যা ও দর্শন সম্পর্কে এ ধরনের সাধারণ ভাবনা রয়েছে, যেমনটি আপনি বলেছেন, যদিও আপনাকে অসাধারণ বলে মনে করি (যেহেতু আপনি স্বাধীনভাবে সত্য সন্ধানী)।

কিন্তু ভাই, দর্শনের মূল শাখা হিসাবে অধিবিদ্যার আরো আলোচ্য বিষয় রয়েছে। সেগুলো হলো সত্তা কী, অস্তিত্ব কী, বাস্তব কী ইত্যাদি। বস্তু আদৌ রয়েছে কিনা– এমন বিষয় অধিবিদ্যার অতি পুরাতন ও অদ্যাবধি অমীমাংসিত বিষয়।

সুতরাং, এই যে টেবিলের উপরে ল্যাপটপে লিখছি, পাশে একটি মোবাইল সেট আছে, একটি বাতি জ্বলছে ইত্যাদি বাস্তব, যা সম্বন্ধে অধিবিদ্যা খাটে না– এসবও অধিবিদ্যার কোনো কোনো পণ্ডিতের দৃষ্টিতে আদৌ বাস্তব কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

আপনি দর্শন চর্চা করেন অথবা পছন্দ করেন বলেই এটি বললাম, যা সাধারণ মানুষের হজম করতে কষ্ট হবে। তারা দার্শনিকদের পাগল ভাববে। স্বাভাবিক।

বিজ্ঞানের বেলায় ‘পেয়ে গেছি’ টাইপের দাবি কতটুকু গ্রহণযোগ্য বা বাস্তব, তা বৈজ্ঞানিক বা বিজ্ঞানের দার্শনিকরা ভালো বলতে পারবেন; কিন্তু দর্শনের ক্ষেত্রে সবই অমীমাংসিত। বিশেষ করে, আপনার উল্লেখ করা বাস্তব, জ্ঞান ইত্যাদি। আত্মা তো অনেক পরের কথা।

আর আত্মার কথা আমি পরে বলেছি। মূল বিষয়টি হলো বস্তু-অতিরিক্ত কিছু আছে কিনা।

আমার যুক্তির মূল কথা হলো: বর্তমানের বস্তু অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর বস্তর তুলনায় অনেকটাই অ-বস্তু। এবং বস্তু-অতিরিক্ত একটা কিছু আছে, পাশ্চাত্য চিন্তাবিদেরা যাকে মন বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং তাঁদের কেউ কেউ (আচরণবাদীরা) মনের ধারণাকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন।

চিজম দেখানোর চেষ্টা করেছেন, আমরা কখনোই বিলিফকে নলেজ হতে বাদ দিতে পারি না। আমরা যতই যাচাইয়ের কথা বলি না কেন সকল যাচাই-ই আংশিক যাচাই, বাকিটুকু যুক্তি, যা মূলত বিশ্বাস। যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদীরা পরোক্ষ যাচাইকে স্বীকার করে নিয়ে তাদের তত্ত্বকে বাঁচাতে গিয়ে মূলত মৃত্যুর জন্য পরিত্যাগ করেছেন।

বস্তু-অবস্তু তথা বস্তু ও মনের দ্বন্দ্বের নিরিখে আপনি বস্তুর বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করুন। এরপর দেখুন সেসবের অতিরিক্ত কিছু থাকা যুক্তিগ্রাহ্য হচ্ছে কিনা। দেখুন, অনুভবে আমরা বস্তুকে পাই। ধরে নিলাম এটি সত্যি। তাহলে অনুভব স্বয়ং বস্তু, না অনুভবে যা পাই তা বস্তু? যদি অনুভব স্বয়ং বস্তু হয়, তাহলে তেমন ‘বস্তু’র সাথে কথিত মনের পার্থক্য খুব একটা থাকে না। আর যদি অনুভবে বস্তুকে পাই তাহলে প্রশ্ন থেকে যাবে, অনুভব কী? যদি বলেন, অনুভব জ্ঞানের প্রক্রিয়া, তাহলে প্রশ্ন উঠবে জ্ঞান আর জ্ঞানের বিষয় কি এক? অন্য কথায়, কর্তা ও কর্ম কি মূলত এক?

আপনি হয়তো ভাবছেন, অ-বস্তুকে স্বীকার করলে বস্তুতে বিশ্বাস হালকা হয়ে যায়; কিম্বা মনকে স্বীকার করলে আত্মাকে স্বীকার করতে হয় যার পথ ধরে আধ্যাত্মিকতা বা ধর্ম চলে আসে! না, তা নয়। আমার পোস্টের মূল বক্তব্য হচ্ছে খাঁটি বস্তুবাদ অগ্রহণযোগ্য ও সেল্ফ-রিফিউটিং। কিন্তু সেজন্য বস্তুকে অস্বীকার করার বা বস্তুর ধারণাকে খাটো করার দরকার নাই। বস্তুকে ঘিরে অ-বস্তু (যাকে আমরা মন বলি) আর অ-বস্তুগত কিছু একটার কার্যফল বা কনসিকোয়েন্স হচ্ছে বস্তু। বিশেষ করে প্রাণের ক্ষেত্রে এটি বেশি স্পষ্ট।

আপনি যদি কর্তাকে ক্রিয়ার বাহিরে বিবেচনা না করে কর্তাকে ক্রিয়ার সমষ্টি মনে করেন, তাহলে আপনার সাথে আমার আর মিলল না। অবশ্য আমি মনে করি না যে, ক্রিয়াবিহীন কর্তার অস্তিত্ব সম্ভব। আবার আমি এও মনে করি না যে, কর্তা হলো ক্রিয়া-সমষ্টিমাত্র। বুদ্ধি, সিদ্ধান্ত, পছন্দ, প্রবণতা, বিশ্বাস, জ্ঞান, বিবেচনা– এসব মানসিক বিষয় কর্তা-পরিচায়ক অর্থাৎ কর্তার বৈশিষ্ট্য, যা কর্মে প্রয়োগ করা হয়। কর্তা হলো অ-বস্তু, কর্ম হলো বস্তু। সাদামাটাভাবে এটি হলো ব্যাপার।

ধন্যবাদ, টু ট্র্যাক মাই পোস্ট।

পারভেজ আলম: আপনার আলোচনা ভালো হয়েছে, তবে আমি মনে হয় একটু পরিস্কার করে বললে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে। অধিবিদ্যা অবশ্যই আত্মা নিয়ে চিন্তা করবে, তাতে সমস্যা নাই। কিন্তু আমি মৃত্যুর কারণ থেকে আত্মা খোঁজার পুরনো অধিবিদ্যক পদ্ধতির বিরুদ্ধে, যেহেতু মৃত্যুর কারণ নিয়ে আমাদের বাস্তব জ্ঞান আছে।

আর সত্তা নিয়ে কিন্তু অনেক আধুনিক অধিবিদ্যক চিন্তার বিকাশ ঘটেছে। আপনি কি মার্টিন হাইডেগার পড়েছেন?

সত্তা নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। আর সত্তার ক্ষেত্রে চিন্তায় এখনো অধিবিদ্যার বিকল্প নাই। আমারও সত্তা নিয়ে অধিবিদ্যক চিন্তা আছে। তবে সেটা শুরু করি এমন জায়গা থেকে যেখানে বাস্তব এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আপাতত এসে শেষ হয়েছে বা আটকে গেছে।

আর ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা এসে যাওয়ার ভয় আমি পাই না। আর আধ্যাত্মিকতার সাথে ধর্মকেও মিলাই না। আধ্যাত্মিকতাকে আমার কাছে অলৌকিক বা পারলৌকিক নয়, বরং খুব লৌকিক জিনিস মনে হয় এবং নিজেও খুব আধ্যাত্মপ্রেমী মানুষ। তবে এটাকে প্রচলিত সেন্সে না নিলেই ভালো। কারণ, আমার আধ্যাত্মিকতা রহস্যময় কিছু নয়, কিন্তু তাই বলে এর আমেজ এক ফোটা কমও নয়।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ধন্যবাদ। তবে আপনি কর্তা ও কর্মের পৃথকীকরণ বিষয়ে কিছু বললেন না! বিশেষ করে এ বিষয়ে:

অনুভবে আমরা বস্তুকে পাই। ধরে নিলাম এটি সত্যি। তাহলে অনুভব স্বয়ং বস্তু, না অনুভবে যা পাই তা বস্তু? যদি অনুভব স্বয়ং বস্তু হয়, তাহলে তেমন ‘বস্তু’র সাথে কথিত মনের পার্থক্য খুব একটা থাকে না। আর যদি অনুভবে বস্তুকে পাই তাহলে প্রশ্ন থেকে যাবে, অনুভব কী? যদি বলেন, অনুভব জ্ঞানের প্রক্রিয়া, তাহলে প্রশ্ন উঠবে জ্ঞান আর জ্ঞানের বিষয় কি এক? অন্য কথায়, কর্তা ও কর্ম কি মূলত এক?

পোস্টটির সামহোয়্যারইন লিংক

আপনার মন্তব্য/প্রশ্ন লিখুন

ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক।

*